বৃহস্পতিবার, ০৩ Jul ২০২৫, ০৪:৫৮ অপরাহ্ন
গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের চলমান দমন-পীড়ন ও সম্ভাব্য গণহত্যায় সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এইসব বহুজাতিক কর্পোরেশন সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরায়েলের দখলদার নীতিকে সহায়তা করছে।
অধিকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চলে নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রানচেসকা আলবানিজের প্রকাশিত প্রতিবেদনটি বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত হবে। তাতে ৪৮টি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছে- যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি জায়ান্ট মাইক্রোসফট, গুগলের মূল কোম্পানি অ্যালফাবেট ইনক ও অ্যামাজনের মতো সংস্থা। এর বাইরে আরও এক হাজার কোম্পানির একটি ডেটাবেস তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব কোম্পানি শুধু দখলদারিত্বেই জড়িত নয়, বরং এখন তারা এক ধরনের ‘গণহত্যার অর্থনীতির’ অংশ হয়ে গেছে। আলবানিজ আগের এক বিশ্লেষণেও জানিয়েছিলেন, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দেওয়ার জন্য ‘যথেষ্ট যৌক্তিক ভিত্তি’ রয়েছে।
সেনা সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর জড়িত থাকার প্রমাণ
প্রতিবেদনে ইসরায়েলের যুদ্ধ বিমান এফ-৩৫ কেনা সম্পর্কিত বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র ক্রয় কর্মসূচির কথা বলা হয়, যা অন্তত আটটি দেশের ১৬০০ কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক লকহিড মার্টিন এই প্রকল্পের নেতৃত্বে রয়েছে।
ইতালির লিওনার্দো এসপিএ সামরিক খাতে অন্যতম যোগানদাতা হিসেবে তালিকাভুক্ত এবং জাপানের এফএএনইউসি করপোরেশন অস্ত্র তৈরির রোবোটিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে।
প্রযুক্তি খাতও ইসরায়েলের পক্ষে ভূমিকা রাখছে। ফিলিস্তিনিদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং সরকারি ব্যবহারে সহায়তা করে ইসরায়েলের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে। মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট ও অ্যামাজন ইসরায়েলকে তাদের ক্লাউড ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক প্রযুক্তিগুলোর ‘প্রায় পূর্ণাঙ্গ সরকারি ব্যবহারের সুযোগ’ দিয়েছে।
প্রতিবেদনটি আরও বলছে, মার্কিন সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান আইবিএম ইসরায়েলি সামরিক ও গোয়েন্দা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং ইসরায়েলের জনসংখ্যা, অভিবাসন ও সীমান্ত কর্তৃপক্ষের (পিআইবিএ) কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ পরিচালনা করছে। এই ডেটাবেজে ফিলিস্তিনিদের বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষিত।
এছাড়া, প্যালানটির টেকনোলজিস নামক মার্কিন সফটওয়্যার কোম্পানি ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের সহযোগিতা বাড়ায়। এই কোম্পানি ‘ল্যাভেন্ডার’, ‘গসপেল’ ও ‘হোয়ার ইজ ড্যাডি’ নামক এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করছে- যা যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষের জীবন-মৃত্যু নির্ধারণ করছে।
অন্যান্য কোম্পানি
প্রতিবেদনে আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে, যারা বেসামরিক প্রযুক্তি তৈরি করলেও সেগুলো ইসরায়েলের দখলদারত্বে ‘দ্বৈত-ব্যবহারযোগ্য’ যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এর মধ্যে রয়েছে- ক্যাটারপিলার, রাডা ইলেকট্রনিক ইন্ডাস্ট্রিজ (লিওনার্দোর মালিকানাধীন), দক্ষিণ কোরিয়ার এইচডি হুন্দাই, সুইডেনের ভলভো গ্রুপ। এসব প্রতিষ্ঠান বাড়িঘর ভাঙচুর ও পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি নির্মাণে ব্যবহৃত ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বুকিং ডট কম ও এয়ারবিএনবি প্ল্যাটফর্মগুলো অবৈধ বসতিতে ঘরবাড়ি ও হোটেলের তালিকা দিয়ে দখলদারত্বকে স্বীকৃতি দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ড্রামন্ড কোম্পানি ও সুইজারল্যান্ডের গ্লেনকোর—এ দুই প্রতিষ্ঠান কলম্বিয়া থেকে কয়লা সরবরাহ করে, যা ইসরায়েলের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
কৃষি খাতে চীনের ব্রাইট ডেইরি অ্যান্ড ফুড ইসরায়েলের বৃহত্তম খাদ্য সংস্থা নুভার মালিক। প্রতিষ্ঠানটি ফিলিস্তিনি জমি দখল করে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনায় লাভবান হয়।
মেক্সিকোর ৮০ শতাংশ মালিকানার নেটাফিম ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান অর্বিয়া অ্যাডভান্স করপোরেশনের কাছে পশ্চিম তীরে পানি উত্তোলন ও ব্যবহারযোগ্য করার প্রযুক্তি সরবরাহ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রেজারি বন্ড (রাষ্ট্রীয় ঋণপত্র) গাজার যুদ্ধে অর্থায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশ্বের বৃহত্তম ব্যাংক, যেমন ফ্রান্সের বিএনপি পারিবাস ও যুক্তরাজ্যের বার্কলেস ইসরায়েলকে ঋণসুবিধা দিয়েছে, যা যুদ্ধ চলাকালে সুদের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করেছে।
কারা এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে?
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বৃহত্তম বিনিয়োগ কোম্পানি ব্ল্যাকরক ও ভ্যানগার্ডকে এসব অপরাধে অর্থায়নকারী প্রধান করপোরেট বিনিয়োগকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্ল্যাকরকের বিনিয়োগ- পালানটিরে ৮ দশমিক ৬ শতাং, মাইক্রোসফটে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, অ্যামাজনে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও লকহিড মার্টিনে ৭ দশমিক ২ শতাংশ অংশীদার।
ভ্যানগার্ড- কেটারপিলারে ৯ দশমিক ৮ শতাং, পালানটিরে ৯ দশমিক ১ শতাংশ, এলবিট সিস্টেমসে ২ শতাংশ মালিকানা।
ব্যবসায়ীরা কি ইসরায়েলের মাধ্যমে লাভবান হচ্ছে?
গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের পেছনে বৈশ্বিক করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অংশগ্রহণ ও লাভের বিষয়টি উঠে এসেছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ফ্রানচেসকা আলবানিজের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের দখলদার রাজনীতিকে সমর্থন দিয়ে এবং সেই প্রক্রিয়ায় অর্থায়ন করে কর্পোরেট সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধে অংশীদার হয়ে উঠছে।
প্রতিবেদনে ইসরায়েলের দখলদারতাকে ‘ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী পুঁজিবাদের’ একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে অভিহিত করা হয়। বলা হয়, এই দখলের অর্থনীতি বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি লাভবান করছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় হামলা শুরুর পর থেকেই এই অর্থনীতির জালে বহু বহুজাতিক কোম্পানি জড়িয়ে পড়েছে। একই সময়ে ইসরায়েলের সামরিক ব্যয় ৬৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬৫০ কোটি মার্কিন ডলারে। এতে ইসরায়েল বিশ্বের সর্বোচ্চ মাথাপিছু সামরিক ব্যয়কারী দেশগুলোর তালিকায় উঠে এসেছে।
ইসরায়েলি অস্ত্র ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর শেয়ারমূল্য ব্যাপক হারে বেড়েছে। তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জে রেকর্ড ১৭৯ শতাংশ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৭৯০ কোটি ডলারে। এই প্রবৃদ্ধি যুদ্ধকালীন সময়ে করপোরেট লাভের এক নিদর্শন হিসেবে ধরা পড়েছে।
বিশ্ববিখ্যাত বিমা সংস্থা অ্যালিয়্যাঞ্জ ও অ্যাক্সাও বিপুল অঙ্কের অর্থ ইসরায়েলের শেয়ার ও বন্ডে বিনিয়োগ করেছে। যদিও আংশিকভাবে এটি মূলধন রিজার্ভ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে, তথাপি তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল আর্থিক লাভ। এই প্রবণতা ‘ব্যবসায়িক লাভ বনাম মানবিক দায়বদ্ধতার’ প্রশ্ন সামনে এনেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এয়ারবিএনবির মতো প্ল্যাটফর্ম ইসরায়েলের অবৈধ বসতিগুলোতে ভাড়ার মাধ্যমে মুনাফা করেছে। যদিও ২০১৮ সালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য অবৈধ বসতির তালিকা সরিয়ে ফেলা হয়, পরে তা পুনরায় যুক্ত করা হয় ‘মানবিক কাজে আয় দান’ করার অজুহাতে। এই কৌশলকে ‘হিউম্যানিটারিয়ান-ওয়াশিং’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও কি আন্তর্জাতিক আইনে দায়ী হতে পারে
প্রতিবেদনে জোর দিয়ে বলা হয়, করপোরেট সংস্থাগুলোর দায়িত্ব হলো- আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মান্য করা ও তার লঙ্ঘন থেকে বিরত থাকা। হোক সেটা সরাসরি হোক, কিংবা ব্যবসায়িক সম্পর্কের মাধ্যমে।
রাষ্ট্রগুলো প্রাথমিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেও, করপোরেট সংস্থাগুলোকেও স্বাধীনভাবে মানবাধিকার রক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, এমনকি, যদি সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র সেটি বাস্তবায়নে ব্যর্থও হয়।
ব্যবসায়িক কার্যক্রম বা সরবরাহ চেইনে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের সম্ভাবনা থাকলে তা নিরূপণ ও প্রতিরোধে সংস্থাগুলোকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এই ব্যর্থতা তাদের অপরাধমূলক দায়ে ফেলতে পারে এবং এমনকি সংস্থার উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখিও করা যেতে পারে।
আইসিজের রায় ও জাতিসংঘের পদক্ষেপ
২০২৪ সালের জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) এক পরামর্শমূলক রায়ে জানায়, ইসরায়েলের পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে দখলদারত্ব অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। এই রায়ের ভিত্তিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ইসরায়েলকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে দখলদার কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশ দেয়।
আলবানিজের প্রতিবেদনে বলা হয়, আইসিজের এই রায় কার্যত ইসরায়েলের দখলদারতাকে ‘আগ্রাসনের কাজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অতএব, করপোরেট ও রাষ্ট্রীয় উভয় পর্যায়ে যারা এই দখলের অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলছে, তাদের ভূমিকা আন্তর্জাতিক অপরাধে অংশগ্রহণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, যেন তারা ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক বা বিনিয়োগ সম্পর্ক স্থাপন না করে। পাশাপাশি বিদ্যমান সম্পর্কগুলোকেও পুনর্মূল্যায়ন করে এমন সব কার্যক্রম থেকে সরে আসতে হবে, যা দখলদারতাকে বজায় রাখতে সহায়তা করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রতিবেদন কর্পোরেট জগতকে নৈতিক ও আইনি দিক থেকে চ্যালেঞ্জ জানায়। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মানবাধিকার রক্ষার নামে গঠিত আন্তর্জাতিক কাঠামোর সামনে এখন কর্পোরেট অর্থনীতির ভূমিকা এক বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র: আল জাজিরা