শনিবার, ০৯ অগাস্ট ২০২৫, ০৯:১৮ পূর্বাহ্ন
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে সদ্যঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্র ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার একটি অসম্পূর্ণ প্রতিচ্ছবি, যা সমৃদ্ধ ও সর্বজনীন হতে পারেনি এবং একই সঙ্গে যা ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নকে অনিশ্চিত করে তুলেছে বলে মনে করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ-পরবর্তী এক যৌথ বিবৃতিতে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি রিফাত রশিদ ও সাধারণ সম্পাদক হাসান ইনাম এ প্রতিক্রিয়া জানান।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দপ্তর সম্পাদক শাহাদাত হোসেনের পাঠানো এক বিবৃতিতে বিষয়টি বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ’২৪-এর জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছিল মূলত প্রায় দেড় দশক ধরে চলা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ, তার দোসর ও গণহত্যাকারী শেখ হাসিনার দুঃশাসন, নিপীড়ন ও গুম-খুনের বিরুদ্ধে জমে ওঠা ঘনীভূত বিস্ফোরণ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সংঘটিত এই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল ফ্যাসিস্ট ও খুনি হাসিনার পতন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলোপ এবং একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত।
কিন্তু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে সদ্যঘোষিত বহুল প্রতীক্ষিত জুলাই ঘোষণাপত্রে অভ্যুত্থানপন্থি ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষা পুরোপুরি উপেক্ষিত হয়েছে এবং একই সঙ্গে এতে ইতিহাস বিকৃতির মতো ঘটনাও ঘটেছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, প্রথমত এতে উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের কথা উল্লেখ থাকলেও উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ পর্ব ১৯৪৭-এর কথা অনুল্লেখিত রয়ে গেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মনে করে, ’৪৭, ’৭১ ও ’২৪ এই তিনটি পর্বই এই ভূখণ্ডের মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাস; যার প্রতিটিই আমাদের গৌরবের অংশ। তাই এই সবকিছুর একটি সম্মিলন এই ঘোষণাপত্রকে আরও সমৃদ্ধ, পরিপূর্ণ ও ঐতিহাসিকভাবে সংবেদনশীল করে তুলতে পারত।
দ্বিতীয়ত, পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা চত্বর গণহত্যা, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদ, মোদিবিরোধী আন্দোলন এবং ভ্যাটবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো এই ঘোষণাপত্রে অনুপস্থিত।
তৃতীয়ত, এটি হওয়ার কথা ছিল একটি প্রোক্লেমেশন, কিন্তু বাস্তবে তা এখন কেবল একটি ডকুমেন্টস-এ পরিণত হয়েছে। কারণ, এটি নিজে থেকে নিজেকে বলবৎ করছে না; বরং পরবর্তী সরকারের কাছ থেকে বৈধতা আদায়ের প্রত্যাশায় ধর্না দিচ্ছে।
চতুর্থত, এতে বিদ্যমান সংবিধানের সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। বলা বাহুল্য, কার্যত তা অসম্ভব। হয় একটি সম্পূর্ণ নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে অথবা মৌলিক সাংবিধানিক সংস্কার করতে হবে, যার অর্থ বিদ্যমান সংবিধানের ক্ষমতাকাঠামোর আমূল পরিবর্তন। কিন্তু সংসদে গিয়ে সংবিধান সংস্কারের প্রতিশ্রুতি মূলত বিদ্যমান সংবিধানকে ঘষামাজা করার শামিল।
পঞ্চমত, এতে ইতিহাস বিকৃতির ঘটনা ঘটেছে। কারণ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘ডাকে’ না; বরং তারাই ছিল এই গণঅভ্যুত্থানের মূল নেতৃত্বদানকারী প্ল্যাটফর্ম, যা এতে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
ষষ্ঠত, এতে শহীদদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণা দেওয়া হলেও তাদের হত্যাকারীদের বিচার সম্পন্ন করার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি।। একই সঙ্গে এতে শহীদদের প্রকৃতসংখ্যা তুলে ধরতে না পারা হাজারও শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অন্তর্বর্তী সরকারে ব্যর্থতা, যা জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি।
সপ্তমত, এতে পরিস্কারভাবে পরবর্তী সংসদের হাতে সংস্কারের দায়িত্ব এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্বীকৃতি তুলে দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে একদিকে সংস্কারকে অনিশ্চিত করা হয়েছে, অন্যদিকে সংস্কারকে বিদ্যমান সংবিধানের সংশোধনীতে সংকুচিত করা হয়েছে। কারণ, রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্র (সংবিধান) রাষ্ট্রের একটা অর্গান (সংসদ) পরিবর্তন করতে পারে না। ফলে এই প্রক্রিয়ায় যা হবে, তাকে আর ‘সংস্কার’ বলা যাবে না। এই ডকুমেন্ট মূলত সংস্কারকে বিলীন করারই শামিল। তাই পরবর্তী সংসদ নয়; নির্বাচিত গণপরিষদ অথবা গণভোটের মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক সংস্কার সাধন করতে হবে।
বিবৃতিতে বলা হয়, জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ভবিষ্যৎ রূপরেখার বহু গুরুত্বপূর্ণ উপাদানই এতে অনুপস্থিত; পাশাপাশি সংস্কার বাস্তবায়নের ভুল পদ্ধতি চয়ন, গোটা সংস্কার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ ও অনিশ্চিত করে তুলেছে।
সংস্কার বাস্তবায়নের সঠিক পথ নির্ধারণ করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের প্রতি ইনসাফ কায়েম করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন৷