শনিবার, ০৯ অগাস্ট ২০২৫, ০৯:১৯ পূর্বাহ্ন
শুধু আবেগে নয়, তথ্য, ইতিহাস ও বাস্তবতার নিরিখে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন যে, ইসলামী সভ্যতা শুধু একটি ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তি নয়, এটি ছিল এক পূর্ণাঙ্গ মানবিক সংস্কৃতি, যা জ্ঞান, বিজ্ঞান, ন্যায়বিচার, নৈতিকতা, শিল্প, সাহিত্য, উদ্ভাবন এবং নেতৃত্বের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অসামান্য অবদান রেখেছে। ইসলামের প্রথম যুগ থেকে শুরু করে আন্দালুস, বাগদাদ, কায়রো, কর্ডোভা ও সমরকন্দ পর্যন্ত ইতিহাসের যে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রচিত হয়েছে, তা আজও সমগ্র মানবজাতির জন্য এক গর্বের স্মারক। গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, দার্শনিক চিন্তাচর্চা, ভূগোল, কৃষিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বহু শাখায় মুসলিম মনীষীদের অবদান অনস্বীকার্য।
সুতরাং যদি এই গৌরবময় ইতিহাসকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হতো তাহলে আজকের জটিল বিশ্ববাস্তবতায়ও ইসলামী চিন্তাধারা ও সভ্যতা যে কতটা প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়, তা সহজেই প্রতীয়মান হতো।
শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান
‘পড়ো’ শব্দটি দিয়েই কোরআনের প্রথম ওহি শুরু হয়েছে, যা প্রমাণ করে, ইসলামে জ্ঞান অর্জন কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই আদর্শ ধারণ করেই মুসলিমরা ইতিহাসের পাতায় শিক্ষাক্ষেত্রে অমোচনীয় অবদান রেখেছেন।
চিকিৎসাক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান
ইসলামের শিক্ষায় যেমন আত্মার পবিত্রতার গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি দেহের পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্য রক্ষা করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ এমন কোনো রোগ পাঠাননি, যার প্রতিকারও তিনি নাজিল করেননি। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৬৭৮)
এই হাদিস মুসলমানদের চিকিৎসাবিজ্ঞানের পথে অগ্রসর হওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
বিশ্বসভ্যতায় মুসলমানদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলোর একটি হলো হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা। ইসলামের প্রথম যুগে চিকিৎসাসেবা ছিল নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ঘরানার হাতে সীমাবদ্ধ; কিন্তু মুসলমানরা তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন। ইতিহাসে প্রথম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিক, যিনি প্রথমে কুষ্ঠরোগীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে মুসলমানরা অসংখ্য হাসপাতাল গড়ে তোলেন, যেগুলোকে ‘বিমারিস্তান’ (অর্থাৎ অসুস্থদের জন্য ঘর) বলা হতো। এই বিমারিস্তানগুলোতে চিকিৎসা ছিল বিনামূল্যে, ছিল ওষুধ সরবরাহেরও ব্যবস্থা, এমনকি মানসিক রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড এবং নারী চিকিৎসার জন্য নারী ডাক্তারও নিয়োগ করা হতো। এসব ব্যবস্থা ছিল একেবারে আধুনিক হাসপাতালের পূর্ণরূপ, যা বিশ্বের অন্য কোনো সভ্যতায় তখন কল্পনাও করা হয়নি।
বিশ্ববরেণ্য মুসলিম চিকিৎসকদের মধ্যে অন্যতম হলেন আবু বকর আল-রাজি (রহ.)। তিনি ছিলেন একাধারে একজন চিকিৎসক, দার্শনিক ও গবেষক। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত রচনাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘আল-হাওয়ি’। তিনি প্রায় ৩০টি চিকিৎসা সম্পর্কিত তত্ত্ব-তথ্য বিশদভাবে উপস্থাপন করেন। আরেক কিংবদন্তি চিকিৎসক হলেন ইবনে সিনা, যাঁকে ‘চিকিৎসাবিদ্যার রাজপুত্র’ নামে অভিহিত করা হয়। তাঁর অমর গ্রন্থ ‘আল-কানুন ফি তিব্ব’ সাত শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ইউরোপ ও এশিয়ার চিকিৎসাবিদ্যায় পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এতে চিকিৎসার মৌলিক নীতি, রোগের শ্রেণিবিন্যাস এবং চিকিৎসাপদ্ধতি সুচারুভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইসলামের স্বর্ণযুগে আরো বহু জ্ঞানী চিকিৎসক ও গবেষক মানবতার কল্যাণে অসামান্য অবদান রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম আবু কাসিম জাহরাবি ইতিহাসের প্রথম আধুনিক সার্জন হিসেবে খ্যাত। তিনি অস্ত্রোপচার পদ্ধতির ওপর বিশাল রচনা ‘আত-তাসরিফ’ গ্রন্থে উপস্থাপন করেন। ইবনু নাফিস, যিনি প্রথম মানুষ হিসেবে হৃদযন্ত্র ও রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া (পালমোনারি সার্কুলেশন) ব্যাখ্যা করেন। আল-বিরুনি—একজন বহুমুখী জ্ঞানী, যিনি চিকিৎসার পাশাপাশি ফার্মাকোলজিতে (ঔষধবিজ্ঞান) বিশেষ অবদান রাখেন।
বিজ্ঞানে মুসলমানদের অনন্য অবদান
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে মুসলিম পণ্ডিতদের অবদান শুধু প্রভাবশালীই নয়, বরং যুগান্তকারী। তাঁরা এমন সব জ্ঞান ও আবিষ্কারের দ্বার উন্মোচন করেছিলেন, যা পাশ্চাত্য বিশ্বের পণ্ডিতদের প্রশংসা ও বিস্ময়ে অভিভূত করেছিল। পশ্চিমা গবেষকরা আজও স্বীকার করেন যে, বিজ্ঞানের বহু শাখায় মুসলিম ও আরব পণ্ডিতদের ভিত্তি স্থাপন ছাড়া আধুনিক বিজ্ঞান এত দূর এগোতে পারত না। বিশেষ করে গণিত বিজ্ঞানের কথা বললে, মুসলিম পণ্ডিতরা এতে অসাধারণ অবদান রেখেছেন। পাটিগণিত, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি ও জ্যামিতির মতো শাখাগুলো তাঁদেরই অবদান। তাঁরা শুধু বিদ্যমান সূত্র ও জ্ঞানের পুনরাবৃত্তি করেননি, বরং সেগুলোকে উন্নত করে নতুন তত্ত্ব ও পদ্ধতির সৃষ্টি করেন।
এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খোয়ারিজমি, যাঁকে আধুনিক কম্পিউটিংয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকারী এবং ‘কম্পিউটারের জনক’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। তিনি নবম শতাব্দীতে গণিতের বিভিন্ন শাখায় যুগান্তকারী কাজ করেন। তাঁর লেখা বই ‘আল-জাবর ওয়াল মুকাবালাহ’ থেকে ‘অ্যালজেব্রা’ (বীজগণিত) শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর উদ্ভাবিত গাণিতিক পদ্ধতিগুলোই পরে ‘অ্যালগরিদম’ নামে পরিচিতি পায়, যা বর্তমান কম্পিউটারবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান ভিত্তি।
এভাবেই ইসলামের স্বর্ণযুগে অসংখ্য মুসলিম পণ্ডিত বিভিন্ন শাখায় অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। যেমন—ভূগোল ও মানচিত্রাঙ্কনে মাসউদি, ইদরিসি; স্থাপত্য ও শিল্পকলায় সিনান পাশা, আন্দালুসিয়ার মুসলিম স্থপতিরা; জ্যোতির্বিদ্যায় আল-বিরুনি, আল-ফারগানি; রসায়নে জাবির ইবনে হাইয়ানের মতো ব্যক্তিরা। তাঁদের গবেষণা, সৃষ্টি ও চিন্তাধারা শুধু মধ্যযুগীয় জ্ঞানচর্চার দ্বার খুলে দেয়নি, বরং আধুনিক সভ্যতার অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান রেখেছে। বর্তমান বিশ্বের অগ্রগতি ও প্রযুক্তির অনেক স্তম্ভ আজও এসব মুসলিম মনীষীর মৌলিক অবদানের ওপর নির্ভরশীল।