শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৫৯ অপরাহ্ন

যুক্তরাষ্ট্রের হামলা ঠেকাতে কতটা প্রস্তুত ভেনেজুয়েলা?

যুক্তরাষ্ট্রের হামলা ঠেকাতে কতটা প্রস্তুত ভেনেজুয়েলা? যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই হামলা করে, তাহলে তা মোকাবিলার সক্ষমতা আছে ভেনেজুয়েলার? তারা কি পারবে বিশাল তেল সম্পদ ও জনগণকে রক্ষা করতে? কয়েকদিন ধরেই এসব প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন মহলে।

ভেনেজুয়েলা সরকার গত মঙ্গলবার জানিয়েছে, দেশটির উপকূলের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় তারা ‘বৃহৎ জাতীয় সামরিক মোতায়েন’ শুরু করেছে।

এর আগে বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রও একটি নতুন অভিযান ঘোষণা করেছে। ‘সাউদার্ন স্পিয়ার’ নামে ওই অভিযানের লক্ষ্য পশ্চিম গোলার্ধে তথাকথিত ‘নারকো-সন্ত্রাসীদের’ দমন করা।

এই উত্তেজনা ভেনেজুয়েলায় উদ্বেগ বাড়িয়েছে। দেশটির কর্মকর্তারা মনে করছেন, প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানোর অজুহাত হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এসব সামরিক তৎপরতা বাড়াচ্ছে।

কারাকাসে এক অনুষ্ঠানে ভেনেজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভান গিল বলেন, ‘আমরা আমেরিকান সাম্রাজ্যকে বলছি, সাহস করে কিছু করবেন না: আমরা প্রস্তুত।’

তবে প্রশ্ন উঠছে—যুক্তরাষ্ট্রের হামলা বা আগ্রাসনের মুখে ভেনেজুয়েলা সত্যিই কতটা প্রস্তুত? তাদের সামরিক সামর্থ্য কতটা? এবং এখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নিকোলাস মাদুরোর রাজনৈতিক হিসাব কী?

কী ঘটেছে?

কয়েক সপ্তাহ ধরে ওয়াশিংটন–কারাকাস উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ক্যারিবীয় সাগর ও পরে প্রশান্ত মহাসাগরে যেসব নৌকা তারা ধ্বংস করেছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রমুখী মাদক বহন করা হচ্ছিল।

এ সপ্তাহেই এমন ২০তম হামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। এতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০ জন নিহত হয়েছে। তবে কোনো নৌকায় মাদক ছিল বা সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছিল, এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ প্রকাশ করেনি যুক্তরাষ্ট্র। হামলার কোনো আইনি ভিত্তিও দেখাতে পারেনি তারা, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ বলে মনে করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

ওয়াশিংটনের অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু একটি প্রমাণবিহীন দাবি, মাদুরো নাকি কার্টেলগুলোর সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচার করছেন।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলা উপকূলে শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড পাঠিয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে গাইডেড-মিসাইল ডেস্ট্রয়ার ও সহায়ক জাহাজ। চার হাজারের বেশি সেনা এবং অগণিত ট্যাকটিক্যাল বিমানের সমন্বয়ে এটি একটি অত্যাধুনিক নৌবহর।

বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সামরিক উপস্থিতি বাড়াচ্ছে, তাদের লক্ষ্য ঘোষিত উদ্দেশ্যের চেয়েও বিস্তৃত এবং এতে মাদুরো-বিরোধী সামরিক চাপও যুক্ত হয়েছে।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক মার্ক ক্যানসিয়ান বলেন, ফোর্ড মূলত সমুদ্রে বা স্থলে শত্রুর বিরুদ্ধে বড় আকারের আক্রমণের জন্য। মাদকবিরোধী অভিযানে এটি আদর্শ নয়।

তিনি আরও বলেন, এই মোতায়েন স্থায়ী হতে পারে না। বিশ্বের নানা অঞ্চলে এমন শক্তিশালী জাহাজের চাহিদা রয়েছে।

ভেনেজুয়েলা কি প্রস্তুত?

ভেনেজুয়েলা সরকার বলেছে, সম্ভাব্য মার্কিন হামলার মুখে তারা ‘বৃহৎ পরিসরের’ সেনা ও বেসামরিক মোতায়েন শুরু করেছে।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভ্লাদিমির পাদ্রিনো লোপেজ জানান, ‘ইনডিপেনডেন্স প্ল্যান ২০০’-এর ‘উচ্চতর পর্যায়’ সক্রিয় করা হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা জোরদারের উদ্যোগ।

তিনি বলেন, প্রায় দুই লাখ সেনা জাতীয় ভূখণ্ডে মোতায়েন করা হয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দাবি, দেশটির সামরিক বাহিনী ঐক্যবদ্ধ এবং ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ ভেনেজুয়েলার ওপর কোনো আগ্রাসন সমর্থন করে না।

বিশ্লেষকদের মতে, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘শ্যাভিজমো’ মতাদর্শের অধীনে গড়ে ওঠা ভেনেজুয়েলার সামরিক প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন খুবই দৃঢ়। এতে তারা সহজে ভাঙবে না।

ভেনেজুয়েলার সামরিক সক্ষমতা কেমন?

গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের তথ্যমতে, ২০২৫ সালে সামরিক শক্তিতে বিশ্বের ১৬০ দেশের মধ্যে ভেনেজুয়েলার অবস্থান ৫০তম। লাতিন আমেরিকায় তাদের অবস্থান সপ্তম।

সিএসআইএস’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার বিমানবাহিনী ছোট এবং আংশিকভাবে কার্যকর। তাদের ৪৯টি বিমানের মধ্যে প্রায় ৩০টি সচল। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে মাত্র তিনটি এফ-১৬ উড়তে সক্ষম।

অন্যদিকে রাশিয়ার নির্মিত এসইউ-৩০ যুদ্ধবিমান ভেনেজুয়েলার প্রধান শক্তি। এগুলোর অন্তত ২১টি সচল রয়েছে, যা আল্ট্রাসনিক অ্যান্টি-শিপ মিসাইল বহনে সক্ষম।

যুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমেই ভেনেজুয়েলার বিমানঘাঁটি ও বিমান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে অঞ্চলটিতে এফ-৩৫ স্টিলথ ফাইটার মোতায়েন করেছে।

গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ারের মতে, ৩ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার দেশ ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনীতে ৩ লাখ ৩৭ হাজার সক্রিয় সামরিক সদস্য রয়েছে। তাদের মধ্যে ১ লাখ ৯ হাজার সক্রিয় সদস্য, ২ লাখ ২০ হাজার আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য এবং বাকি আট হাজার রিজার্ভ কর্মী।

তবে ভেনেজুয়েলার জনবল বেশি হলেও বছরের পর বছর যুদ্ধ–প্রশিক্ষণের অভাব ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকেন্দ্রিক বাহিনীতে রূপান্তর বড় দুর্বলতা হয়ে উঠতে পারে।

দেশটির নৌবাহিনীও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় খুবই দুর্বল। সার্বিকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির সঙ্গে ভেনেজুয়েলার তুলনা চলে না বলেই মত বিশ্লেষকদের।

তবে স্থানীয় প্রতিরোধ ও গেরিলা–ধরনের লড়াইয়ের সম্ভাবনা বাস্তবিক উদ্বেগ তৈরি করতে পারে। অরিনোকো রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা এলিয়াস ফেরর বলেন, ‘যদি সংঘাত হয়, ভেনেজুয়েলা দেশটিকে পরিচালনার অযোগ্য করে তুলতে পারে—এটাই অসম যুদ্ধের সময় ।

যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যিই হামলা করবে?

ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, মাদকপ্রবাহ ঠেকাতেই সামরিক তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য মাদুরোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করা।

ট্রাম্প বলেছেন, তিনি ভেনেজুয়েলায় অনুপ্রবেশ চান না। অনেক বিশেষজ্ঞের মত, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান কৌশল এখনো রাজনৈতিক, সামরিক নয়।

ভেনেজুয়েলার বিশ্লেষক কার্লোস পিনা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য মাদুরোকে চাপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য করা। সরাসরি আক্রমণ সবচেয়ে কম পছন্দনীয় বিকল্প।

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, এত বড় সামরিক উপস্থিতি দেখানোর পর যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটলে তা ট্রাম্পের জন্য রাজনৈতিক পরাজয় হিসেবে দেখা হবে, ফলে চাপ কমানোর বদলে তারা আরও বাড়াতে পারে।

সূত্র: আল-জাজিরা
কেএএ/

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved bijoykantho© 2025