রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১০:১৩ অপরাহ্ন
ট্রেড বেইজড মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে প্রায় ১৭টি করপোরেট প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বিভিন্ন দেশে ৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচারের ঘটনা ঘটে। এই অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান এএসএফ রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান ও আহমেদ শাহরিয়ার রহমানসহ মোট ২৮ জন ব্যক্তি।
এছাড়া জড়িত মোট ১৯টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সিআইডি বলছে, রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দুবাইয়ের আর আর গ্লোবাল ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে চলে যেত সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইউকে, ইউএসএ, আয়ারল্যান্ড ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে। আর আর গ্লোবাল ট্রেডিংয়ের মালিক মূলত সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান এবং এএসএফ রহমান এর ছেলে আহমেদ শাহরিয়ার রহমান। তাদের নামেই নিবন্ধিত আর আর গ্লোবাল ট্রেডিং।
১৭টি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে সালমান এফ রহমানসহ অভিযুক্ত ২৮ ব্যক্তি ও ১৯টি প্রতিষ্ঠান অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মর্মে দায়ের করা মামলার তদন্তে নিশ্চিত হয় সিআইডি।
রোববার (৯ নভেম্বর) বিকেলে মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. ছিবগাত উল্লাহ।
তিনি বলেন, বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে প্রায় ৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা তদন্ত শেষে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের অনুমোদন পেয়েছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট।
সিআইডি প্রধান বলেন, বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান এএসএফ রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এবং অন্যান্য সহযোগীরা মোট ১৭টি করপোরেট প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে এই অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- Adventure Garments, Apollo Apparels, Autumn Loop Apparels, Bextex Garments, Cosmopolitan Apparels, Cozy Apparels, Esses Fashion, International Knitwear And Apparels, Kanchpur Apparels, Midwest Garments, Peerless Garments, Pink Maker Garments, Platinum Garments, Skynet Apparels, Springful Apparels, Urban Fashions এবং Winter Sprint Garments Limited
তদন্তে আরও উঠে আসে, তারা এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনতা ব্যাংক পিএলসি, মতিঝিল শাখা, ঢাকা থেকে এলসি বা বিক্রয় চুক্তির ব্যবস্থা করেছিল, তবে রপ্তানির বিপরীতে অর্জিত অর্থ দেশে ফেরত নিয়ে আসেনি। এভাবে রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দুবাইয়ের আর আর গ্লোবাল ট্রেডিং- এর মাধ্যমে চলে যেত সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইউকে, ইউএসএ, আয়ারল্যান্ড ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে। আর আর গ্লোবাল ট্রেডিংয়ের মালিকানা সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান এবং এএসএফ রহমান এর ছেলে আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের নামে নিবন্ধিত।
এই প্রক্রিয়ায় ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মোট বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১২০০ কোটি টাকা রপ্তানি দেখানো হয়েছে। কিন্তু রপ্তানির বিপরীতে অর্জিত অর্থ দেশে ফেরত আনা হয়নি; অর্থাৎ রপ্তানিমূল্য প্রত্যাবাসন না করে বিদেশে অর্থপাচার করা হয়েছে।
প্রাথমিক তদন্তের বরাতে সিআইডি প্রধান বলেন, এ ঘটনায় সিআইডি বাদী হয়ে গত বছরের ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর মতিঝিল থানায় ১৭টি মানিলন্ডারিং মামলা দায়ের করে। এরই মধ্যে এসব মামলা সংক্রান্তে আদালতের আদেশে আসামিদের বিভিন্ন সম্পদ ক্রোক করেছে সিআইডি। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা জেলার দোহার থানার ২ হাজার শতাংশ জমি ও তদস্থিত স্থাপনাসমূহ, গুলশানের ‘দ্য এনভয়’ বিল্ডিংয়ের ৬,১৮৯.৫৪ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট এবং গুলশান আবাসিক এলাকার আরও একটি ট্রিপ্লেক্স ফ্ল্যাট। এছাড়া সিআইডির আবেদনের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার পাশাপাশি তাদের বিদেশ গমনও রোধ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ক্রোককৃত সম্পত্তির বর্তমান আনুমানিক মূল্য ৬০০/৭০০ কোটি টাকা।
উল্লিখিত ১৭টি মামলায় বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান এএসএফ রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান ও আহমেদ শাহরিয়ার রহমানসহ মোট ২৮ ব্যক্তি ও জড়িত মোট ১৯টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগে তদন্ত শেষে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন বিজ্ঞ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের নিমিত্তে সিআইডি প্রধান কর্তৃক অনুমোদন প্রদান করা হয়েছে।
সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি ছিবগাত উল্লাহ বলেন, আসামিদের মধ্যে জেল হাজতে থাকা সালমান এফ রহমানকে এসব মামলায় গ্রেফতার দেখানোর পাশাপাশি বেক্সিমকো গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান Autumn Loop Apparels Limited-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডার ওয়াসিউর রহমানকে চলতি বছরের জুলাই মাসে গ্রেফতার করেছে সিআইডি।
ছিবগাত উল্লাহ আরও বলেন, সিআইডি ধারাবাহিকভাবে দেশের যেসব অর্থ অবৈধভাবে লন্ডারিং হয়েছে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আমাদের দেশের ইকোনমিকে ভেঙে দেওয়ার জন্য যে দুর্দান্ত যে নষ্ট-নষ্ট খেলা ছিল এগুলোর বিরুদ্ধে সিআইডি টিম প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। এই ৯৭ মিলিয়ন ডলার দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের সকল প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। আমাদের কাজটি আমরা করেছি। এ ব্যাপারে যত স্টেকহোল্ডার আছে, আমরা চাই তারা যেন তাদের কাজটি সুসম্পন্ন করে এই টাকাগুলো দেশে ফেরত নিয়ে আসতে পারবে।
এক প্রশ্নের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কৌঁসুলি দলের বিশেষ উপদেষ্টা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, বেক্সিমকো গ্রুপের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনের অধীনে দায়ের করা মামলার তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। আমরা আশাবাদী অতি শিগগির এই মামলার চার্জশিট দাখিল করা হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত চার্জশিট দাখিল না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ইট ইজ এ প্রাইভেট ডকুমেন্ট। যখন চার্জশিট সাবমিট হয়ে যাবে তখন সেটা হবে পাবলিক ডকুমেন্ট। এই মামলায় জনতা ব্যাংকের কে বা কারা অভিযুক্ত এই মুহূর্তে বলাটা সমীচীন বলে না।
রপ্তানি এবং আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং আন্ডার ইনভয়েসিং মাধ্যমে বিপুল অর্থ পাচার হয়। এখন এটা কি আপনারা বন্ধ করতে পারছেন কি না? জানতে চাইলে সিআইডি প্রধান বলেন, বন্ধ করাটা তো সিআইডির কাজ না। এই যে দুর্নীতি যেটি হয়েছে এটাকে এড্রেস করা কনসার্ন আইনের ভেতর থেকে আমরা সেটি করার চেষ্টা করছি। আর এই সবকিছু বন্ধ করার জন্য সামগ্রিকভাবে আমজনতার সচেতনতা দরকার। আমরা বিশ্বাস রাখি তদন্ত ও সচেতনতা অব্যাহত থাকলে একসময় এগুলো বন্ধ হবে। আইনের শাসন যখন হবে, যখন দোষী সাজাপ্রাপ্ত হবে, তখন ডেফিনেটলি এগুলো বন্ধ হবে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে সিআইডি প্রধান বলেন, সিআইডির ওপরে বিন্দুমাত্র কোনো চাপ নেই। মানি লন্ডারিংয়ের যে প্রসেস এটা আগে অনুসন্ধান করতে হয় এটার জন্য অনেক সংস্থা থেকে অনেক কাজ করতে হয়। যে ওয়েতে মানিটা লন্ডারিং করেছে এই ফ্লো এগুলো বের করা কিন্তু অনেক টাফ। আমরা অসংখ্য ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান অর্গানাইজেশনের বিরুদ্ধে কিন্তু মানি লন্ডারিং মামলা করেছি। চার্জশিট দিয়েছি। প্রথমে অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়, সম্পদ ক্রক করা হয়। আমরা কাউকেই মনে করি না, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে। যে যত বড় শক্তিশালী হোক না কেন আইনের আওতায় নিয়ে আসার আমাদের কাজ ও তদন্ত অব্যাহত আছে।
এসময় উপস্থিত ছিলেন, সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের প্রধান অ্যাডিশনাল ডিআইজি আলী আকবর খান ও ফাইন্যানশিয়াল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত ডিআইজি রায়হান উদ্দিন খান, সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান।