শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৫:০৬ অপরাহ্ন

বিএনপির দাবি উপেক্ষা করে সুপারিশ পাঠাচ্ছে কমিশন

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয়েছে নতুন বিতর্ক। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা সনদে স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু, আইনি ভিত্তি স্পষ্ট না হওয়ায় সংস্কারসংক্রান্ত বেশি উৎসাহী দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জুলাই সনদে সই করেনি। একই পথে হেঁটেছে বাম ঘরানার চারটি রাজনৈতিক দল। এখন সনদের আইনি বৈধতা নিশ্চিত করতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। দু-একদিনের মধ্যেই কমিশন সরকারের কাছে সংবিধান আদেশ বা জুলাই জাতীয় সনদ আদেশ জারির সুপারিশ জমা দেবে। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে আলাদা আদেশ জারির প্রস্তাব বিবেচনা করছে সরকার।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই সনদ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি ‘ন্যূনতম ঐকমত্যের’ সূচনা করেছে। তবে বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পারস্পরিক আস্থার অভাব বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুলাই সনদের আইনি রূপ নির্ধারণ না হলে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে। সব পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে সনদটি ‘রাজনৈতিক ঐকমত্যের বদলে বিভাজনের দলিল’ হয়ে দাঁড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। তারা আরও বলছেন, জুলাই সনদ স্বাক্ষরের দিনে জুলাই যোদ্ধাদের আন্দোলনের মুখে শেষ মুহূর্তেও সনদে কিছু বদল আনে ঐকমত্য কমিশন। এখন এনসিপিসহ বামপন্থি দলগুলোর আপত্তি দূরীকরণে সম্ভবত সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় জোর দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সনদ বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। সেটা নিয়ে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টির শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুতির পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। আর সেই অন্তর্বর্তী সরকার সব রাজনৈতিক দলকে এক প্ল্যাটফর্মে আনতে ফেব্রুয়ারিতে গঠন করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের আলোচনায় প্রাধান্য পায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ’। গত ১৭ নভেম্বর জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করেন বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী সংবিধান সংশোধনের বদলে একটি আলাদা আদেশ জারির প্রস্তাব বিবেচনায় রয়েছে সরকার। এতে জুলাই সনদকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন নীতি-নির্দেশনা’ হিসেবে কার্যকর করার পরিকল্পনা চলছে। সনদ বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ হিসেবে অগ্রগতি হবে। দ্বিতীয় ধাপে ওই আদেশের ওপর অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। তবে, আদেশ জারি সমর্থন করে না বিএনপি। আবার জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ কয়েকটি দল একটি আদেশ জারির দাবি জানিয়ে আসছে।

জানা গেছে, বিএনপি সনদটিকে ‘জাতীয় পুনর্গঠনের রূপরেখা’ হিসেবে দেখছে। জামায়াতে ইসলামী একে রাজনৈতিক সংস্কারের ন্যূনতম ঐকমত্য’ বলে উল্লেখ করেছে, আর তরুণদের নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপি বলছে- ‘সনদের ধারাগুলো বাস্তবায়নযোগ্য করতে দলীয় সংলাপ ও কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। বেশকিছু প্রশ্নে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে রেখেছে বিএনপি। এর পক্ষে যুক্তিও দিচ্ছে অকুণ্ঠিতভাবে। নোট অব ডিসেন্টসহ গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে জুলাই সনদে। তাতে আবার প্রশ্ন উঠেছে। এজন্য জুলাই সনদের আদেশ জারি করবে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার।

আদেশ জারি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরস্পরবিরোধী অবস্থান বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কিছু না বলায় এনসিপি সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বর্জন করেছিল। শুধু বর্জন নয়, তারা একটি সমাবেশ ঘটিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজনে বাধা দিয়েছিল। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সমবেত ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়েছে। জনমনে ধারণা, এনসিপি এটি ঘটিয়েছে, যদিও দলটির শীর্ষ নেতাদের কেউ ওই সমাবেশে ছিলেন না। ফলে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য ক্ষুণ্ণ হয়েছে। এত সময় ও শ্রম দিয়ে এ আয়োজনের ব্যবস্থা হলেও তা শুরুতেই হোঁচট খেয়েছে।

ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সনদ বাস্তাবয়ন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়েছে। এতে দুটি পথ রয়েছে। একটি জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সংবিধান আদেশ কিংবা জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ আদেশ। এই দুটির ব্যাপারে যেকোনো একটি হতে পারে। আমার মনে হয় না এ নিয়ে রাজনৈতিক দলে কোনো মতপার্থক্য রয়েছে।’

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার বলেন, ‘জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে এবং তার রূপরেখা না দেখে আমরা সই করতে পারব না। আমরা চাই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশটা প্রধান উপদেষ্টা জারি করুক। জনগণ অনুমোদন করল মানে পুরো সনদাটাই অনুমোদন করল। এখানে নোট অব ডিসেন্ট প্রাধান্য পাবে না।’ জামায়াত নেতা ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, ‘সনদ বাস্তাবায়ন নিয়ে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, এটির সমাধান হলো আদেশ জারি। গণঅভ্যুত্থানের পক্ষ থেকে সরকার আদেশটা জারি করবে। এটাই হলো সবচেয়ে কনস্টিটিউশনাল সাউন্ড পদক্ষেপ।’

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক আদেশ দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশের অধিকারটাকে খর্ব করা। এটা বিএনপি মানেনি, মানবেও না।’

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved bijoykantho© 2025