বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৩১ পূর্বাহ্ন
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর গাজায় নেমেছে স্বস্তির নিঃশ্বাস। দীর্ঘ এক বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাত, ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক বিপর্যয়ের পর যুদ্ধবিরতির ঘোষণা যেন মরুভূমিতে এক বিন্দু বৃষ্টির সমান। কেউ হেঁটে, কেউ গাড়িতে, কেউ বা গরুর গাড়িতে চড়ে গাজার উপকূলীয় সড়ক ধরে উত্তর গাজার দিকে যাত্রা শুরু করেছেন নিজ গৃহে ফেরার আশায়। বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, ছিন্নভিন্ন জীবন, হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জন, সব কিছুর মাঝেও মানুষের হৃদয়ে এখন জেগে উঠেছে ঘরে ফেরার আকুলতা আর চোখেমুখে আশার ঝিলিক।
ধ্বংসস্তূপে ফেরা মানুষদের বেদনা : তবে আনন্দের সঙ্গে উদ্বেগও আছে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ফিরে আসা মানুষ দেখেছেন তাদের শহর, স্কুল, হাসপাতাল ও ঘরবাড়ি প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েলি বাহিনী গাজা সিটিতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ চালিয়ে অসংখ্য ভবন ও আবাসিক এলাকা গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
জামাল মেসবাহ নামের একজন ফিলিস্তিনি জানান, ‘যুদ্ধ থেমেছে শুনে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি, কিন্তু আনন্দ নেই- শুধু বেদনা।’ দক্ষিণের শহর খান ইউনিসে ফিরে আসা ফাতমা রাদওয়ান জানান, ‘কিছু কাপড়, কাঠের টুকরো আর হাঁড়িপাতিল ছাড়া বাড়ি বলে কিছু নেই। মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে লাশ তুলছে।’
আরেক বাসিন্দা হানি ওমরান বলেন, ‘এটা এখন আর কোনো শহর নয়, এটা এক অচেনা ধ্বংসভূমি। চারপাশে শুধু ধ্বংস আর ধুলোবালি।’ আহত কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে পদযাত্রায় অংশ নেওয়া নাবিলা বাসাল নামের এক ফিলিস্তিনি বলেন, ‘এটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না- আল্লাহর অশেষ শুকরিয়া, আমরা খুবই খুশি যে যুদ্ধ থেমেছে, কষ্টের দিন শেষ হয়েছে।’
এক বছরের ভয়াবহ যুদ্ধের চিত্র : গাজা উপত্যকা গত এক বছরে মানবতার এক ভয়াবহ চিত্র হয়ে উঠেছে। ২০২৩ সালে শুরু হওয়ায় ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞে এখন পর্যন্ত ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নিহতদের প্রায় অর্ধেকই নারী ও শিশু। জাতিসংঘ ও স্বাধীন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো এই পরিসংখ্যানকে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বলে মনে করেন। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে; হাসপাতাল, স্কুল ও আশ্রয়কেন্দ্রগুলো পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। খাদ্য, পানি, ওষুধের অভাবে সেখানকার মানুষ যে দুর্দশার ভেতর দিয়ে গেছে, তা বর্তমান যুগে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকবে।
সহায়তার অনুমতি পেল জাতিসংঘ : ইসরায়েল জাতিসংঘকে গাজায় মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার অনুমতি দিয়েছে। জাতিসংঘের এক কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, কয়েকদিনের মধ্যে ১ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য, ওষুধ ও জরুরি পণ্য গাজায় প্রবেশ করবে। এসব পণ্য এরইমধ্যে জর্ডান ও মিসরে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। গত কয়েক মাসে গাজায় প্রয়োজনীয় সহায়তার মাত্র ২০ শতাংশ পৌঁছাতে পেরেছিল বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবিকবিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার।
চুক্তির পরবর্তী ধাপ ও আন্তর্জাতিক ভূমিকা : চুক্তি অনুযায়ী, পাঁচটি সীমান্ত ক্রসিং পুনরায় খোলা হবে, যার মধ্যে রয়েছে মিসর সীমান্তের রাফাহ ক্রসিং। এর ফলে খাদ্য ও ওষুধসহ জরুরি পণ্য পৌঁছাবে গাজায়, যেখানে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য প্রায় ২০০ মার্কিন সেনা ইসরায়েলে পাঠানো হবে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্ব দেবে গাজার পুনর্গঠন কার্যক্রমে, যেখানে আন্তর্জাতিক তহবিল ব্যবহার করা হবে। চুক্তির অংশ হিসেবে ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (চঅ) ভূমিকা রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে, যদিও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। কর্তৃপক্ষকে বড় ধরনের সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, যা সম্পূর্ণ হতে সময় লাগতে পারে কয়েক বছর। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি শিগগিরই মিসর সফরে যাবেন এবং এ বিষয়ে আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
ভবিষ্যতের প্রশ্ন : এই যুদ্ধবিরতি যদি টিকে থাকে, তবে তা শুধু গাজার মানুষের জন্য নয়, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার জন্য এক মোড় ঘোরানো মুহূর্ত হতে পারে। এই সাময়িক বিরতিকে স্থায়ী শান্তির পথে নিয়ে যেতে হবে কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্যায়ে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার ও মানবিক সহায়তা প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি হলেও, মূল প্রশ্ন এখন- এই যুদ্ধের স্থায়ী সমাধান কোথায়? যদি ন্যায্য রাষ্ট্রীয় অধিকার, নিরাপত্তা ও মর্যাদার নিশ্চয়তা না মেলে, তাহলে এই শান্তি শুধু বিরতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখন দায়িত্ব, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গাজা পুনর্গঠন ও মানবিক সহায়তার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা। জাতিসংঘ, ওআইসি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব বিশ্বকে যৌথভাবে একটি টেকসই শান্তি-রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে ফিলিস্তিনের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও নিরাপদ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা থাকবে।
সবশেষে এখন একটাই চাওয়া, ফিলিস্তিনের শিশুদের মুখে আবার হাসি ফিরুক- এই শিশুরা যেন নিরাপদে বেড়ে উঠতে পারে- যেখানে বোমার শব্দ নয়, স্কুলের ঘণ্টা বাজবে, যেখানে আতঙ্ক নয়, শিক্ষার আলো জ্বলবে। যুদ্ধবিরতি যেন শুধু বিরতির নাম না হয়ে, স্থায়ী শান্তি ও পুনর্গঠনের সূচনা হয়। সেই দিনের প্রতীক্ষাতেই আমরা। আশা করি, ফিলিস্তিনের শিশুরা হাসবে, স্বপ্ন দেখবে এবং নিরাপদ জীবন কাটাবে। এটাই আজ সমগ্র মানবজাতির প্রত্যাশা। যুদ্ধবিরতি যেন স্থায়ী শান্তির সূচনা হয়, প্রতিশোধ নয়, পুনর্গঠনের অধ্যায় খুলে দিক- এই হোক বিশ্বসমাজের আহ্বান।